বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ এক কলঙ্কিত দিন। ১৯৮১ সালের এই দিনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার নামে সাজানো মামলায় সামরিক আদালতে প্রহসনমূলক বিচারে ১২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একই অভিযোগে বিচারের রায়ে ১৯৮৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আরো এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেয়া হয়। সে সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের কুটচালে মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসি দেয়া হয়। ৪০ বছর ধরে এই সেনাকর্মকর্তাদের স্বজনরা জানতে পারেন নি তাদের অপরাধ কি ছিল। তারা কোনো ক্ষতিপূরণ বা চাকরিবিধির সুবিধা পর্যন্ত পাননি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সেনা কর্মকর্তাদের কোর্ট মার্শালে বিচারের বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তদন্ত করে, এই কোর্ট মার্শাল ও ফাঁসির রায় অন্যায্য ও আইনবহির্ভূত বলেছিল। কোর্ট মার্শালের রায় বাতিলের জন্য তখন সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছিল। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন ও ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ওই সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
জিয়া হত্যার জড়িত থাকার অভিযোগে সেনাপ্রধান এরশাদ তড়িঘড়ি করে যে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনাক কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেন তারা হলেন,ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, কর্ণেল এম এ রশীদ বীর প্রতীক, কর্ণেল নওয়াজেশ উদ্দিন পিএসসি, লে. কর্নেল মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম, লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীক, লে. কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেন, মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মেজর রওশন ইয়াজদানি ভুঁইয়া বীর প্রতীক, মেজর কাজী মমিনুল হক, মেজর মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক ও লেঃ রফিকুল হাসান খান।
তাদের প্রাণ রক্ষায় মানবাধিকার সংগঠন এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতারা এব্যাপারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সঙ্গে কথা বলতে বঙ্গভবনে যান। কিন্ত রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাক্ষাৎ দেননি। বঙ্গভবনের গেটে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা ফেরত আসেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে ড. কামাল হোসেন, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও এডভোকেট সিরাজুল হকসহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা ২২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে দশটার দিকে প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনের বাসায় রিভিউ পিটিশন নিয়ে হাজির হন। কিন্ত প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন রিভিউ পিটিশন প্রত্যাখ্যান করে আইনজীবীদের বলেন, “কোর্টকে সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে রাখাই বাঞ্ছনীয়।” বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ এবং মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদও যৌথ বিবৃতিতে জাতির সূর্য সন্তানদের ফাঁসি না দেয়ার আবেদন জানায়। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের জীবন রক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে জেনারেল ওসমানিকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল,কিন্ত ওসমানিও সেদিন রহস্যজনক নিরবতা পালন করেন। অথচ তার অধিনে এসব মুক্তিযোদ্ধা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল। সকল আবেদন-নিবেদন ও আইনগত পদক্ষেপ উপেক্ষা করে তদানীন্তন বিএনপি সরকার জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। ১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ৩ টার মধ্যে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও যশোর কারাগারে একে একে তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির আগে ১২ মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম ইচ্ছাটুকুও পুরণ করতে দেয়া হয়নি। জেল কোড অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের ৭২ ঘন্টা আগে দণ্ডপ্রাপ্তদের জানানোর বিধান থাকলেও মাত্র এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে তুলে আত্মীয়-স্বজনদের সংগে সাক্ষাতের সুযোগ না দিয়ে দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।
প্রহসনের এই বিচারে ১০ জন সেনা কর্মকর্তাকে ৬ থেকেই ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১৯ জন অফিসারকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। জাতির এই বীর সন্তানদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে পরবর্তিতে জেনারেল এরশাদ প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
গবেষক ও লেখক আনোয়ার কবিরের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ, “তেরজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি এবং সশস্ত্রবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা”গ্রন্থে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ দ্রুততার সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে দিয়ে ৪ জুলাই সেনা আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী মেজর জেনারেল আব্দুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, ব্রিগেডিয়ার নুসরাত আলী কোরেশী, কর্নেল মোহাম্মদ মতিউর রহমান বীরপ্রতীক কর্নেল মফিজুর রহমান চৌধুরী, লেঃ কর্নেল মাসুদ আলী খান, লেঃ কর্নেল এম মকবুল হায়দার ও লেঃ কর্নেল হারিসকে সদস্য করে একটি কোর্ট মার্শাল গঠন করেন। মেজর জেনারেল মেজাম্মেল হোসেনকে প্রেসিডেন্ট করে করা কোর্ট অব ইনকোয়ারী কমিটির তদন্তের ভিত্তিতে কোর্ট মার্শালটি করা হয়। এই কোর্ট অব ইনকোয়ারির সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হাফিজউদ্দিন, কর্নেল গোলাম কাদের,ও কর্নেল আজিজুর রহমান। কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৩ জনকে। চট্টগ্রাম কারাগারের অভ্যন্তরে ১৯৮১ সালের ১০ জুলাই কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে কোর্ট মার্শালের কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র ১৮ কার্যদিবসে সমাপ্ত হয় কোর্ট মার্শালের কার্যক্রম। ১১ আগস্ট রায় প্রদান করা হয়। রায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, বেশ কয়েকজনকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
কোর্ট মার্শালের এই রায়ের বৈধতা নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর (১৯৮১) হাইকোর্টে রিট করা হলে ৭ সেপ্টেম্বর তা খারিজ করে দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে এই দিনই প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চে আপিল করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর সেই আপিল নাকচ হয়ে যায়। দুপুরে আপিল নাকচ হলে রাত ১২ টার পর ২৩ সেপ্টেম্বরের প্রথম প্রহরে তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন কারাগারে থাকা ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকার কারণে লেঃ কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ফজলে হোসেনের বিচার এই কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হয় নি। পরবর্তিতে ব্রিগেডিয়ার মফিজুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট করে মার্শাল কোর্টে বিচার করে ফজলে হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।